Friday, November 2, 2007

প্রশ্ন

দিনটা আজ স্মরণীয় হয়ে থাকলো। নানান কারনে। এর মধ্যে বিশেষ এক কারণ, মাঝির ফোনকল। সেই মাঝি, যে নিজের পড়াশুনাটা বিসর্জন দিয়ে সংসারের হাল ধরেছিলো। আমার ছোট বেলাকার বন্ধুরা ভিষণ পরিশ্রমী। আমার মতই নানান অপ্রাপ্যতায় তারা জর্জরিত। ভুট্টো দুইদিনও গ্রামের বাড়িতে থাকতে পারেনা, ওর উপর ভর করে আছে বিশাল সংসার। তাই ব্যবসায় ফাঁকি দেবার কোনো অজুহাত নাই। নবী আছে নিজের মতো করেই, গ্রামে ফেরে বছরে দুয়েকবার, আর আমি? হুমমম। ভাগ্য বলিয়া যদি কিছু থাকিয়া থাকে তবে আমি নিশ্চিত আমাদের ভাগ্য সেট-আপ করার সময় ঈশ্বর মদ খেয়ে টাল ছিলো। ব্যাটায় উল্টা-সিদা কি যা তা লিখে রেখেছে কপালে।

মাঝি নামটা নকল নাম। এ নামের চমৎকারিত্বে ওর আসল নামটাই হারিয়ে গেছে। পাহাড়ি ঢলে যখন ফসলের মাঠ ভরে সমুদ্র হতো তখন আমরা ডুব সাঁতার দিয়ে হিন্দু পাড়া থেকে বড় বড় কলাগাছ কেটে ভেঙ্গুরা বানাতাম। এটা একটা শৈল্পিক কাজ। সহজে বানানো সম্ভব না। ৫/৬টা কলাগাছকে মাঝারী সাইজে কেটে পাশাপাশি রেখে এর ভেতরে বাঁশের গজাল ঢুকিয়ে জোড়া লাগানো হতো। ভেঙ্গুরা মাঝি খুব ভালো চালাতে জানতো, তখন থেকেই আমরা ওকে মাঝি বলে সম্বোধন করি। আমাদের একটা ছোট দল ছিলো। সেই দলের নিয়মানুযায়ী সবার একটা করে ছদ্ম নাম অপরিহায্য। মাঝির নামটা সেখানে বিনা বাক্যে টিকে যায়। ভেঙ্গুরা বানানোর দিন শেষ। দীঘির ঘন জলে ডুবাডুবির উচ্ছ্বাসটাও এখন আর নাই। তবু আমরা সেই গুপ্ত দলের সদস্যরা যখনই গ্রামে ফিরেছি, ঘরে ফেরার আগে দীঘির পাড়ে উঠে প্রথমে দিগন্ত ছুঁয়েছি। এটা আমাদের নিখাদ ভালোবাসা। এ আমাদের অনেক কিছু মনে করিয়ে দেয়।

মাঝি আরো একটি মাইল ফলক ছুঁয়েছে। ওর দ্বিতীয় বোনের বিয়ে হচ্ছে ৫ তারিখে। আমাকে যেতেই হবে। ভুট্টো এর মধ্যে চলে গেছে। আম্মাকে ফের ডাক্তার দেখানোর জন্য আমাকে শনিবার অবদি অপেক্ষা করতে হবে। লিটন, মিলন গ্রামেই আছে। নবীকে এখন পেলে হয়। চট্টগ্রামে বিয়েতে প্রচুর খরচ। আকডুম বাকডুম কত কি করে ওখানে। কয়েক দিন ধরে চলে উৎসব। সেসব উৎসবের মধ্যে রঙ ছুঁড়াছুঁড়িটা আমার বিশ্রি লাগে। মনে হয় হলি-খেলা হচ্ছে। কনে পক্ষ বর পক্ষকে কত বড় গরু উপহার দিলো, বর পক্ষ কনে পক্ষকে কি দিলো এমন সব হিসেব নিকেশে আমার অসহ্য লাগে। শুধুমাত্র প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি মহিলাদের বিয়ের গানের আসরটাকে আমার ভালো লাগে। ফাঁকে বিনোদনের জন্য প্রতিরাতেই এখানে মঞ্চ নাটকের ব্যবস্থা করা হয়। এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে গ্রামের উঠতি বয়েসী ছেলেরাই। ভালো তারা খুব একটা যে করতে পারে তা নয়, তবু চেষ্টা করছে ওরা এটাই বড় কথা। মঞ্চের সামনে উৎসুক মানুষের খিলখিল হাসি, অদ্ভুত মুখভঙ্গী, উৎসুক দৃষ্টি দেখতে আমার দারুন লাগে। আমি বেশ কিছু বিয়ের গান রেকর্ড করেছি বিচ্ছিন্ন ভাবে। এবার ইচ্ছা আছে সেসব স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করার।

-> দুপুরে রাশেদের ওখানে হামলা চালালাম। রাশেদ এখন তার নতুন ভাবীকে দুচোখে দেখতে পারেনা। আমিও না। তবু অমন সুন্দর চেহারার দিকে না তাকিয়ে পারিনা। দারুন সুন্দর, ফিগার, চেহারা। স্বভাবটা ভালো না। আন্টি আমার খাবারের সাথে বিশেষ একটা জিনিস সবসময় রাখেন, তিনি জানেন এটা আমার খুব প্রিয়। খাবারের সাথে তিনি মজার এক আচার দেন। বিয়ের পর বৌকে আমি আন্টির কাছে পাঠিয়ে এ আচারের রেসিপি শেখাবো। খাবার বেড়ে দিয়ে বরাবরের মতই তিনি রাশেদের ক্রিয়াকর্মের বিস্তারিত বিবরণ শুনালেন। রাশেদকে ফোন করলাম, বললো রিক্সায় আছে বন্ধুর সাথে! অথচ আন্টি বললেন অন্য কথা- নতুন গাড়ি নিয়ে মেয়ে নিয়ে ঘুরছে সে! আন্টি জানলো কেমনে?!! ঝাড়ি দিয়ে ১৫ মিনিটের মধ্যে আনালাম।
'সবতো মাটি করে দিলি?'
'হুমমম শুনলামতো সব'
'দোস্ত মা কিছু বলেছে নাকি?'
'হ শালা তোকে আদর করতে বলেছে' ও আমার বুকের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে।
'তারপর কি খবর তোর?' আমি ওর মোবাইল ঘাটতে ঘাটতে বলি।
'কি খবর আর, সপ্তায তিনটারে এসপার ওসপার করতাছি'
'বলিস কি বেটা!'
'শুক্রবার সোনিয়া, মঙ্গলবার মিতু, বিৎস্যুতবার লাবনীকে ব্রাউজ করতাছি সমানে।'
'হুমমম''দোস্ত তারপরও রাইতে ঘুম আহে না :( দুইটা করে ট্যাবলেট খাওয়া লাগে'
'ট্যাবলেট খাসনা আর, অভ্যেস হয়ে গেলে সমস্যা'
'আমি নিজেও বুঝি। কিন্তু ঐ খা** মেয়েটা এমন করে...। দোস্ত কি করবো বুঝিনা। রাতে ঘুম আসে না। কিচ্ছু ভাল্লাগে না'
'এটা কেমন কথা, যা ফোট, সিভি রেডি করেছিস?'
'আররর সিভি... চাকরী করে কিচ্ছু হবে না। আর এখন নিজেদের অফিসেতো বসতাছিই, চাকরীর কি দরকার, টাকা দিয়ে কি হইবো?'
'টাকার দরকার নাই সেটা মানলাম, কিন্তু মানুষ সম্পর্কে তোকে জানতে হবে না? নিজেদের অফিসে থেকে একটা মাছিকে পর্যন্ত চিনতে পারবি না। এম.বি.এ তে ভর্তি হচ্ছিস কবে?'
'ভাইয়্যা বললো ইউ.কে যেতে।'
'তুই নির্ঘাত মারা যাবি'
'কেন কেন?'
'এখনো তুই দুধের শিশু। দেখলামতো ঘরের কি অবস্থা করে রেখেছিস? যে ছেলে পানি পর্যন্ত তুলে খেতে জানে না তার জন্য বৈদেশ বাস নিষিদ্ধ।'
'কি বলিস ব্যাটা, ঐটা একটা স্টাইল' বলেই ও মুচকি হাসে।

রাশেদের এই হাসিটা আমার দারুন ভালো লাগে। খুব সাদাসিদে আর লাজুক হাসি। অথচ এ লাজুক হাসির বাইরে ও অন্য মানুষ। কিছুদিন আগেও সে এতোটা ডেসপ্যারাডো ছিলোনা। ওর দাবী ও যেমন ঠকেছে তেমন করে সবাইকে ঠকাবে। ওকে আটকানো যাবে না। ঢাকার মেয়েরা অত্যাধিক প্রগতিশীল, ওরা এমনি এসে ওর কাছে ধরা দেয়। ওকে তাই আমি জোড়ালো ভাবে এসব থেকে বিরত রাখতেও পারিনা। যেখানে ও বিনা পরিশ্রমে পেয়ে যাচ্ছে সেখানে আমি বাঁধা দিতে যাবো কেন? গ্রামের বন্ধুদের সাথে শহুরে বন্ধুদের আমি কখনোই মিক্সিং করতে পারিনা। সম্ভব না। আকাশ পাতাল ব্যবধান। এখানে প্রতিদিন এক একটা ভার্জিন মেয়ে স্বেচ্ছায় বিসর্জিত হয়, প্রতিটি বিসর্জিত মেয়ে প্রতিদিন ভার্জিন সাজায় মগ্ন হয়। এরা এ ফুলে ঢু মেরে ও ফুলে উড়ে যায়। তবে, রাশেদ জীবনে একটা মেয়েকেই ভালোবেসেছে বাকীদের সাথে ও অভিনয় করছে।

একটা পারফেক্ট ছেলের যা যা থাকার দরকার তার সবই রাশেদের আছে, তবু কলি কেনো রাশেদের জন্য অপেক্ষা করেনি?
বিরাট প্রশ্ন।

No comments: