Monday, December 31, 2007

সৃষ্টি


প্রায় এক মাসের সফল কর্মসূচির পর বরগুনা থেকে যখন ঢাকায় ফিরলাম তখন শরীর/মনের অবস্থা যাচ্ছেতাই। মনে মনে ভাবছিলাম লম্বা এক ডুব দিবো। সবকিছু থেকে। খাবো, দাবো, ঘুমে ডোম হবো। তেমন কিছুই হতে দিলো না নিয়তি। জরুরী তলব, বাড়িতে কোরবানি করতে হবে। অবশেষে চাঁন রাতে শেষ টিকিট নিয়ে যখন সৌদিয়ার বাস সার্ভিসে চেপে বসলাম তখনই ফোন। জানানো হলো বড় চাচা মারা গেছেন। গাজীপুর, দেড় ঘন্টার পথ। আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হলো তড়িগড়ি। বাস ছেড়ে দিবে একটু পর। দশ-বিশ-ত্রিশ গুনতে হলোনা। কর্তব্য বলতে শুধু অ্যামেরিকায় এন্সারিং মেশিনে এক মিনিটের বক্তৃতা দিয়েই সিটে শরীর এলিয়ে গভির ঘুমে মগ্ন হলাম। লোকটার প্রতি আমার কোনো মায়া-মমতা ছিলোনা। এখনো নাই। আমার ভেতরে অনেক অনেক জ্বালা, কষ্ট, হতাশা জাগিয়ে লোকটা হুট করে চলে গেছে। এতে আমার হতাশা বেড়েছে বৈ কমেনি।

যাইহোক, নিজের গ্রামে কিছু একটা করার স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কিভাবে শুরু করবো। অবশেষে সেটা এবার দেখতে পেলাম। গ্রামের একটা অংশ বাকি অংশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিপার্শ্বিক সব দিক থেকে তারা পিছিয়ে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেলাম এখানে শিক্ষার হার অন্যান্য অংশের তুলনায় অনেক কম। বন্ধুরা বললো ল্যাদা-ফ্যাদাদের শিক্ষার দিকে নজর দিতে। তাহলেই উন্নয়ন সম্ভব। আমি সেদিকে হাঁটলাম না। মা'দের নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছে করলো। এখানে বয়স্ক/বিবাহিত মহিলাদের শিক্ষার হার অনেক কম। ভেবে দেখলাম যদি এদের কোনো ভাবে শিক্ষিত করতে পারি তাহলে বাজিমাত করা সম্ভব। একজন মা একটি পরিবারের মুল অভিভাবক। মা শিক্ষিত হলে ফ্যামিলি এমনিতেই ডেভেলপ করবে। একজন কর্মজীবি বাবা পরিবারে কতটুকু সময় দিতে পারে? মা পরিবারকে ২৪ ঘন্টা সময় দিয়ে থাকে। উপরোন্তু সন্তানরা বাবার চেয়ে মাকে খুব বেশি কাছে পায়। তারা মায়ের আদর, স্নেহ, ভালোবাসা পেয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। তাই একজন মা যা বলেন সন্তানরা তাই আগ্রহ ভরে করার চেষ্টা করে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সম্পর্কে মা'কে বুঝাতে পারলে পরিবেশের এমন ছ্যাঁড়াব্যাঁড়া অবস্থারও উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। তাই, মা'কে শিক্ষিত করতে পারলে সবকিছুকে শিক্ষিত করার একটা চান্স নেয়া যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো এই ঝানু মহিলাদের কিভাবে বোঝাবো। এর আগে এখানে সরকারীভাবে এমন উদ্যেগের কম চেষ্টা হয়নি। সবই শুরু হয়ে শেষ হয়ে গেছে। সুবিধে হলো এদের কাছে আমি মোটামুটি পরিচিত। আমার এই পরিচিত তাদের ভেতর বিপ্লব ঘটাতে পারে, তাই সুযোগটা কাজে লাগানোর জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলাম।

৫ সদস্যের একটা কমিটি করলাম। এরা ডোনেট করবে। মাসিক যা খরচ হবে তার পুরোটাই এরা বহন করবে। স্কুল ঘর ঠিক করার পর ঘরের মালিক জানালো তাকে ভাড়া দিতে হবে না। কমিটির সবাই এতে ভিষণ খুশি। 'সৃষ্টি' নিয়ে আজম আর মিলনের আগ্রহ দেখে ভালো লাগলো। আমার অবর্তমানে এরা এই কাজটাকে এগিয়ে নিতে পারবে মোটামুটি। অবশেষে চারজন শিক্ষিকার ব্যবস্থা করতে পারা গেল। এদের ৩ জন কোনো টাকা নিবে না। ১ জনকে মাসিক ১০০০ টাকা দিলেই চলবে! পূর্বে দেখতে পেয়েছি প্রায় প্রতিটি প্রোজেক্টের আগে একটা অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে হয়। যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক অনেক কম অর্থনৈতিক প্রেসার 'সৃষ্টিতে' পেলাম। পুরোপুরি গোছগাছ করে সবাইকে নিয়ে স্কুল ঘরে একটা মিটিং এর আয়োজন করা হলো। শুধুমাত্র ছাত্রীদের নিয়ে মিটিং। যারা আসবে তাদেরকে প্রাথমিকভাবে বিনামূল্যে বই, চক, ডাস্টার দেয়া হবে। আমার ধারনা ছিলো লজ্জা-শরম দূরে হটিয়ে ৭/৮জন মতো হয়তো আসবে। সেই অনুযায়ী ১২ জনের জন্য জিনিসপত্র কিনে আনা হয়েছিল। বিপত্তি ঘটলো মিটিংয়ে মহিলাদের উপস্থিতির পর। ৩০/৩৫ জন ছাত্রী দেখে আমার মতই সবাই তাজ্জব! যাই-হোক, ২০ মিনিট টানা ব্রিফ দিলাম। সুবিধে হলো এদের চোখে সহজেই জল এনে ফেলা যায়। এদের একটু ভালোবাসা দেখাতে পারলে এরা মানুষের জন্য কি না করতে পারে? তাদেরকে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হলে :

১। ছাত্রীদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পাঠ্যেদান করা হবে।
২। সপ্তায় ৬ দিন ক্লাশ হবে। ক্লাশ শুরু হবে বিকেল ৩টায়।
৩। ১ জন শিক্ষক সপ্তায় ২টি করে ক্লাশ নিবেন।
৪। সপ্তাহের প্রতি বৃহ:স্পতিবার একটি করে মিটিং হবে। এখানে ছাত্রীদের প্রোগ্রেস, তাদের সমস্যা, অভিযোগ, পারিপার্শ্বিক বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা হবে। অভিযোগ, সমস্যাগুলো আজম লিপিবদ্ধ করে রাখবে। পরের ক্লাশ থেকে তা সংশোধনের চেষ্টা করা হবে।
৫। প্রত্যেক মাসে একটি করে বড় মিটিং হবে। সেখানে কমিটির সবাই উপস্থিত থাকবো। যাবতীয় সমস্যা সমাধান দেয়ার চেষ্টা করা হবে তখন। মজার মজার সব ইভেন্টের মাধ্যমে ছাত্রীদের শিক্ষার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হবে।
৬। কোনো কারণ ছাড়াই কেউ তিন দিন ক্লাশে অনুপস্থিত থাকলে পরবর্তী অনুপস্থিত ক্লাশের জন্য ২ টাকা হারে জরিমানা করা হবে।
৭। আরো কিছু...।

এর মানে হলো আমাকে প্রতি মাসে গ্রামে যেতে হবেই! আমি ত্যাক্ত বিরক্ত হবো না। বরং প্রোজেক্টটা দাঁড়িয়ে গেলে আমার চেয়ে সুখি মানুষ পৃথিবীতে পাওয়া ভার হবে। 'সৃষ্টি' নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। সমস্যা হলো তেমন অরগানাইজ জনোবল নাই। যে চারজন কমিটিতে আছে তারা হাঁ হয়ে আমার সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করে। আমার চাই অরগানাইজ জনোবল আর পাশে দাঁড়িয়ে আশ্বাস দেবার মতো প্রিয়জন। তেমন পাওয়া ভার। দাঁড়িয়াল ঠাকুরের কবিতাই এখন শেষ সম্বল, "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলোরে..."

Friday, December 28, 2007

ডিসেম্বর শূণ্য সাত- কিছু ব্যর্থতা, অভিশাপ আর মুঠো মুঠো একাকিত্ব

গুমোট অন্ধকার ফুড়ে শিশির ঝরছে বৃষ্টির মতো। ঝাপসা পৃথিবী জমে গেছে সীমাহীন নিঃস্তব্ধতায়... নিঃসঙ্গতায়... রাশি রাশি ব্যর্থতায়...। ঘুম আসছেনা। বিছানায় শরীর এলানোর প্রশ্নই ওঠে না। চোখ মুদলেই নিজেকে চামড়া ছোলানো জীব মনে হয়। সেই ছোলানো অংশে অজস্র নোনা জল। মানুষের। অনেক অ-নে-ক জ্বালা ওতে। নিজেকে ছোট করে ফেলে, নিজের কাছে। ছোট ভাবতে একদম ইচ্ছে করেনা। তবু আমি ছোটো। স্পষ্ট করে বললে- নীচ।

এই সীমাহীন অসহনীয় অবস্থায় একটা ব্যপার খেয়াল করলাম। সেটা হলো এতো ঘনিষ্ট বন্ধু-বান্ধব থাকতেও আমি আমার যন্ত্রনাময় ব্যাপারগুলো নিয়ে কারো সাথে ডিসকাস করতে পারছি না। এক চিমটিওনা। এক বিন্দুও না। আবিস্কার করলাম, আদতেই আমি একজন নিঃসঙ্গ ব্যর্থ মানুষ। আমার কোনো বন্ধু নাই।

কোরবানি হচ্ছি প্রতিটি মূহুর্তে। গলায় ছোরা চালিয়ে জবাই করে মেরে ফেলার চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক জবাইয়ে কতযে অসহনীয় যন্ত্রণা সেটা বোঝানো যাবে না। মরছি সমানে। এখানে-সেখানে। কতোশতো ভাবে। ঈশ্বর কেনোযে এতো এতো কাড়ি কাড়ি অপ্রাপ্যতা ঠেসে ঠেসে আমার লাইফে ইমপোর্ট করলো...। এতো কুমির-বোয়াল ফেলে আমাকেই কিনা গাধাটার পছন্দ হলো! আমি নিশ্চিত ঘাড়ের দারোয়ান দুটো কাঁদতে কাঁদতে এতোদিনে মারা-ই গেছে!

অনেক, অ-নে-ক দূর যেতে পারবো কিনা জানিনা। না যেতে পারলে সেটা হবে ব্যর্থতার উপর ব্যর্থতা। ব্যর্থতার ষোলকলা বলতে যা বুঝায় তা পূর্ণ হবে। স্বার্থপর মানুষের মতো কিছু অনৈতিক সিদ্ধান্ত আর কিছু মানুষকে অবমূল্যায়ণ আমার জীবনের চরম এক গোলকধাঁধা। যেখান থেকেই তুমি শুরু করোনা কেনো ঠিক ঠিক সেই আগের অবস্থানে। ঘুরে ফিরে তুমি আসবে। শুরু করবে নতুন করে। আমি সিদ্ধান্ত যা নেই তা সবই সলিড সেটা বলবো না। তবে ম্যাক্সিমাম সলিড। টেকশই। সে নিজের প্রয়োজনেই হোক কিংবা প্রিয় মানুষের। তবে নিজের জন্য যতোগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছি সব বুঝে শুনে নিতে পারিনি। কোনো সফল মানুষও বলতে পারবে না তার সব সিদ্ধান্ত টেকশই ছিলো। সিদ্ধান্ত নেবার আগে আবেগ কাজ করবে। ক্ষোভ থাকবে। অজুহাতের পুঁজি থাকবে। আর একটা বাচ্চা ছেলে ছাড়া তেমন কিছুইতো নই আমি। বয়স কাঁড়ি কাঁড়ি বাড়ছে। তবু অনেক কিছুর ব্যবধানে জড়িয়ে নিজেকে ক্ষুদ্র জীব ছাড়া তেমন কিছু ভাবতে পারিনা। চাইনা। বাঁধনে জড়ানো মানে একটা সার্কেলে আবদ্ধ হওয়া। জমে যাওয়া। তুমি চাইলেই সেই সীমানা অতিক্রম করতে পারো না। তুমি শৃঙ্খলের নিয়মে বাঁধা তখন। তোমাকে অনেক কিছু বুঝে শুনে করতে হবে। বাইরের পৃথিবীকে তুচ্ছজ্ঞান করে চার দেয়ালে সুখের ছবি আঁকতে হবে। কাউকে নিয়ে মিছেমিছি নাটক করতে হবে। প্রতিদিন। এতোসব আমার জন্য নয়। ফেলে আসা জীবন আমার কাছে যতটুকু চায় ততটুকু যদি নাইবা দিতে পারি তো এই জীবনের কোনো মানে হয়না। আমি ফেলে আসা জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। আজ থেকে ১ বছর, ১০ বছর, ২০ বছর পরেও আমার এই ধারনার পেখম রঙ হারাবে না। মানুষ সুখস্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। আমিও চাই। ব্যাস। আমার অভিলাস বলো, চাহিদা বলো, অভিসার বলো... তা এ-ই।

ডিসেম্বর শূণ্য সাত। ডিসেম্বর শূণ্য সাত। অসহনীয় যন্ত্রণা। অসহনীয় যন্ত্রণা...।


------------------------------
সময় : ২৬ ডিসেম্বরের কোনো এক মৃত রাত।
স্থান : পল্লবী, ঢাকা।

Tuesday, December 18, 2007

মানুষ দেখলে তবে আলো

কতোদিন হলো মিরাকল দেখিনা। আমি মিরাকল পেতে, দেখতে ভালোবাসি। কিন্তু মিরাকলতো আমাকে আর দশজন ভদ্র মানুষের মতো ভালোবাসেনা। তাই মানুষের মিরাকল দেখে যাই।

কখনো কাউকে মিরাকল দেই নাই। আজ একজনকে মিরাকল দিলাম।

আমি যে কষ্টটা এতোদিন ধরে লালন করে এসেছি, সেই একই কষ্ট আমার চোখের সামনে অন্য একজন পেতে পারেনা।
অন্তত আমি বেঁচে থাকতে, না। সামর্থ্য আমার তেমন একটা নেই। তবু...

Monday, December 17, 2007

আঁচলে তার অপেক্ষা খেলে

নদিকে দু'ভাগ করে তিরতির করে ছুটে চলছে যলযান। চলছে ছুটে আমার যাবতীয় যতোসব স্থাবর অস্থাবর যন্ত্রণা। উদাসী হলেম আজ। নতুন করে। নদি আমার প্রিয়জন। এর কাছে আবদার চাইতে আমার জড় লাগেনা। যখন ইচ্ছে তখন এতে আমি কল্পনার বসতি গড়ি। ভাঙ্গি। চুড়ি। যেমন ইচ্ছে তেমন গড়ি। এ আমার একান্ত আপনজন। একে দুর্গত করলে আমার ইগো ফুটো হয়না।

গুটগুটে অন্ধকার, চারপাশ। লক্ষ লক্ষ তারা আকাশে। শতো শতো ছেঁড়া তারার ভেলকি ঝলক দেখিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। বহুদূরে মিটমিট করে জ্বলছে ঝাপসা লোকালয়। দুভাগ হবার আগে শুভ্র ফেনা তুলে জলকনা নদিকে আলোড়িত করছে অদ্ভুতুড়ে আবেগের ত্রাস সৃষ্টি করে। যেন বলছে কোনো অনাহুত, নদিকে, প্রিয়তমা নি:শেষ হয়ে যাচ্ছি দ্যাখো, নি:শেষ, এই তোমার পরে।

রাত সাড়ে বারো। লঞ্চের চারতলা ছাদে বসে আছি। একা। নি:স্ব। কনকনে শীত ঝরছে ইচ্ছেমতো। এক্স-হান্ড্রেড বেজে উঠে বিশ্রি রকম সুরে। জানি সে বাজবে। বাজবে। বাজবে। যতোক্ষন না ধরি। ভুলিনি, আজ তার জন্মদিন। কিছু কিছু জন্মদিন ভুলে যাওয়া সম্ভব না। মাঝে মাঝে অসম্ভব রকম অসহায় লাগে। আমি মানুষটা আদতে সুবিধের নই। অনেক অনেক ফাঁকিবাজি, রঙচঙ, কেরামতি, ফক্করবাজি, টক্করবাজি, লক্করবাজি, নক্করবাজি, যেন-তেন যত্তোসব ঝুটঝামেলায় ভরা আমার আমি। মানুষকে ঠকাইনা বড় গলায় ক্যামনে বলি? মানুষকে ঠকাচ্ছিতো।

আমার মটো বলে কিছু নেই। হোপলেস এই আমি জীবনের যতোসব রসকষে ডুবে ডুবে ভেসে যাই। স্থিতি কিংবা বসতি কিংবা সংসার, ধর্ম, কর্ম, নিজের জন্য টুকটাক ভাবনা... আমার দ্বারা হবেনা। এসব জেনেও একজন, শুধু অপেক্ষায় থাকে। তাকে এখন আর বুঝাই না। বলিনা- দ্যাখ রাতের সুপ্ত ছেঁড়া তারারাও হঠাৎ হঠাৎ ভেলকি দেখায়। আমি সেটাও পারিনা।

তারপরও তোর এই জন্মদিনে, তোকে কাঁদিয়ে ভাসালেও একটা কথা না বলার জন্য মনটা আপসোসে ভরে আছে...

সখি, তোর জন্যও কিছু ভালোবাসা ভরে আছে বেদুইইন এই আকাশে। তোকেও হঠাৎ হঠাৎ প্রচন্ডরকম ভালোবাসি।

: রাত ২:১৪ মিনিট, ১৪ ডিসেম্বর, ২০০৭ইং

: ডাইরীর পাতা থেকে।

Tuesday, December 11, 2007

নিয়ে চলো দূরে, আরো দূরে, বহুদূরে...

আজ 'মিথ্যা' কে বিক্রি করলাম। মিথ্যা বিক্রি করা খুব সহজ। শুধু একটু ড্যাম কেয়ার ভাব চেহারায় আনতে হয়। ভাবছি আমার টি-শার্টের পেছনে একটা কথা সেঁটে দেবো-i sell lie। বাসায় ফিরেছি ভোর ৬টায়। ৮ টায় ফের উঠে মামার সামনে গিয়ে বললাম- আই।এল.টি.এস এর জন্য টাকা লাগবে। কিছু টাকা ধার না দিলেই নয় (আহহহ কতো টাকা যে ধার নিলাম!)। তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝার চেষ্টা চালালেন (পুরা বোকা পাবলিক, আমার মিথ্যে ধরা খুব সহজ) তারপর টাকা দিয়ে টো টো জীবনধারন না করা নিয়ে টানা ১০ মিনিট বক্তৃতা দিলেন। কে শুনে কার কথা, আমি তখন মনে মনে সপ্তষীতে চলে গেছি। রানাকে নিয়ে 'জেনুইটি সিস্টেম' এ গেলাম। তারপর 'ঘাস ফড়িং' টাকে ফের রি-নিউ করলাম। হায় আমার ছেঁড়া স্বপ্ন। আমি তোকে বাঁচিয়ে রাখবো, যতদিন বেঁচে আছি।

খুব ক্লান্তি শরীর-মন জুড়ে। টানা ৩ রাত জেগে থাকার দরুন চিন্তা-ভাবনায় ঘুম ঢুকে গেছে। বলার মতো তেমন কিছুই ঘটে নাই এই কয়দিন। তারপরো এখন, এই ভর দুপুরে কিছু লিখবো বলে চোখের দু'পাতা জোর করে খুলে লিখছি। চোখ বন্ধ থাকলেও সমস্যা ছিলনা। টাইপ করতে আমার চোখ খোলা না রাখলেও চলে। কিন্তু চিন্তা-ভাবনাটাতো ঠিক থাকতে হবে। সেটা থাকছেনা।

গতরাত সারারাত মসজিদে ছিলাম। আশ্চার্য্য হবে যেই শুনবে। আমি মসজিদে ছিলাম, তাও সারারাত! যে আমি বৎসরে একবারও যাইকিনা সন্দেহ আছে সেই আমি...! হা হা হা। হেসে লাভ নাই। ভ্রু কুঁচকেও না। মসজিদে ছিলাম দায়ে পড়ে। ওখানেই আমরা ত্রানের সব জিনিসপত্র রেখেছি। ত্রান প‌্যাকেজিং হচ্ছে। ৫০০ পরিবারের ১ সপ্তাহের খাবার, এবং শীতের গরম কাপড়। এটা পুরো ১৫ জন যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে টাকা উঠিয়েছে তাদের ভোটাভোটিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গতকালই তিনজন সদস্যকে পটুয়াখালীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা ওখানে গিয়ে সবচে' ক্ষতিগ্রস্ত ৫০০ পরিবারের হাতে টোকেন দিয়ে আসবে। তারপর আমরা ১৩ তারিখ থেকে সেখানে বিলি করবো। সম্ভবত ১৬ তারিখ সবাই ঢাকায় ব্যাক করবো।


আমার প্ল্যান ছিলো অন্যরকম। আমি বলেছি এই ২ লাখ টাকা দিয়ে অন্তত ২০ টা পরিবার যারা খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের এ-টু-জেড পুনর্বাসন করা হোক। ঘর তোলা থেকে শুরু করে যাবতীয় সবকিছু। কিন্তু আমার প্ল্যানে ভোট পড়ে নাই বেশি। গণতান্ত্রিক নিয়মেই এগুচ্ছি আমরা। আমার একার সিদ্ধান্ততো আর সলিড না। যেটা সবার কাছে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হবে সেটাই করা হবে। এতে আমার কিঞ্চিত পরিমান মনক্ষুন্নতা নেই।

আমার প্ল্যানটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে একটা কারনে। সেটা হলো, মানুষ এখন খুব বেশি ত্রাণ নির্ভর হয়ে গেছে। তারা কাজ-টাজ ছেড়ে ছুঁড়ে ত্রানের জন্য উন্মুখ হয়ে বসে থাকে। কাজ করে ৩০০ টাকা ইনকামের চেয়ে ঘরে বসে ২০০ টাকা উপার্জন অনেক নিরাপদ এবং এতে খাটনীও নেই! অভাবী এবং নিরক্ষর মানুষগুলো শুধু জানে তিনবেলা পেট পুরে খেলেই জীবন চলে যাবে। বেশ আছেতো তারা। তো কাজ করে কি হবে? আমাদের সরকারের উচিৎ তাদের প্রয়োজানুসারে কিছু কর্মসংস্থান করা। যাতে কাজ করে জীবন ধারন করার মানসিকতা অভাবী সর্বহারা মানুষগুলোর মন থেকে না হারিয়ে যায়। যারা ত্রান দিচ্ছে, ঘর বাড়ি উঠিয়ে দিচ্ছে তারা অন্তত পক্ষে যেন পরিবারের কর্তা ব্যক্তিদের দিয়েই যাবতীয় কাজ করায়। এতে ওদের পারিশ্রমিকও দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

মনটা ভিষন খারাপ। কেবল ধু ধু শূন্যতা অস্তিত্ব জুড়ে। বন্ধু বান্ধবরা এতোদিন আমায় পেলো বুঝি। বুঝিনা কিছু। বেশি বাড়াবাড়ি করলে নাকের ডগায় সোজা ঘুষি হাঁকিয়ে দেব। এদিকে নির্ঝরের খুব কষ্ট হচ্ছে। আন্টি 'ট্রোমা সেন্টারে' এখানো ভর্তি রয়েছেন। অপারেশন করা লাগবে। প্রথম দিন সারারাত ছিলাম, পরের দুইরাত থাকতে পারলাম না। আম্মাটাও মোটামুটি অসুস্থ্য। বোনের পরীক্ষা। সেমিষ্টার ফি। নতুন চাকরীর অন্বেষন। কতোশতো ঝুটঝামেলা। কিযে সমস্যা। কিযে সমস্যা। মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে খুব- সামওয়ান প্লিজ আমার মাঝে লীন হও। আমাকে একটু ইন্সপায়ার করো। আমাকে জাগিয়ে তোলো। আমাকে বাঁচিয়ে রাখো। আমাকে হাত ধরে নিয়ে চলো। দূরে। আরো দূরে। বহুদূরে। অনেক দূরে...।

Friday, December 7, 2007

প্রতিপক্ষহীন এই জীবন

তার এই অযাচিত উদ্ব্যেগটা আমার যে ভালো লাগছিলো না তা নয়। ভালো লাগছিলো, একই সাথে একটা ক্ষীন দু:খবোধ। এটা হবার কথা নয়। সময়ের প্যাঁচে মানুষ হারায়ে যায়... এটা ধ্রুব সত্য। একে নিয়ে দু:খবোধ করাটা ঠিক না। রিক্সায় বসেই ওকে দেখতে পেলাম। চোখে মুখে উদ্বেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কতদিন পর গাজিপুর এলাম? সঠিক জানা নেই। তবে অনেক অনেক দিন পর এলাম। পথ ঘাটের কিছুই তেমন চিনি না। বিবর্ণ সবকিছু। মানুষগুলো কেমন তা ঈশ্বর ভালো জানেন। ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম হয়তো সাজবে। সাজেনি। এ মেয়ে কখনোই অতিরিক্ত প্রসাধন ব্যবহার করেনা। সাধারণ সালোয়ার কামিজ পরনে। গায়ে আকাশ রঙের ওরণা। অস্থির আর উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। আমি তার চোখে কৈশোরকে জ্বলতে দেখলাম। হেসে বললো --এতো দেরী লাগে?
-- পথ ঘাটতো চিনি না। পরিচয় হও, আমার বন্ধু রানা।
শেষবার মাস চারেক আগে দেখা হয়েছিলো। তখন এরকম সুস্থির ভাব ছিলো না। সুখে আছে? দু:খবোধটা আরো শক্তপোক্ত অবস্থানে মোড় নেয়। অথচ দু:খবোধ করার কোনো মানে নেই। মানুষ সুখে থাকবেই। কথার ফাঁকে ফাঁকে ও মৃদু শব্দে হাসছিলো। অচেনা এই হাসিটা সম্পূর্ণ আনকোরা। আগে কখনো দেখিনি। মেয়েদের হাসিও তাহলে সময়ের সাথে পাল্টায়! হাঁটছি এলেবেলে কথাবার্তা বলতে বলতে। হঠাৎই, সেই আগের মতো করে আমার এক হাতে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে শুরু করেছে। মনে মনে ভিষন চমকে গেলেও কিছু বললাম না। হাত ছাড়িয়ে নিলাম কথার বাঁকে। যা চুকেবুকে গেছে তাকে জোর করে দৃশ্যপটে হাজির করাটা বোকামী। এ আমি জানি। এমনিতে অভিমান টবিমানের মতো লাল্লু মার্কা অনুভূতিজ্ঞান আমার ভোঁতা। তারপরেও কিছু ব্যাপার থেকে যায়। সেসব থেকে নিজেকে মুক্ত করা কঠিন। ঢাকায় এতোবার দেখা হয়েছে এমন কখনোই হয়নি। রানা পেছনে সরে যায়। গাছের পাতা নড়েছে। কোনো একটা কারণ অবশ্যই আছে। ধক করে ভ্রুটা কুঁচকে যায়। রানা হচ্ছে জীবন্ত বি.বি.সি। বন্ধু সার্কেলের কারো কিছু রানার জ্ঞাত হওয়া মানে সবার জ্ঞাত হওয়া। ঈশ্বর জানেন আমাকে নিয়ে ভবিষ্যতে কি ঘটাবে সে।

বড় চাচা'র বাড়ি যাচ্ছি ১২ থেকে ১৫ বছর বছর পর। এই একটা লোককে আমি চরম ঘৃনা করি। এক সময় দারুন প্রতাপ ছিলো। এখন তার কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই। মি. প্রতাপ মৃত্যুর প্রহর গুনছে আজ। তবু তার একটা বিষয় আমার ভালো লাগে, সেটা হলো লোকটা দারুন ঠোঁটকাটা। মুখের উপর শাট শাট কথা বলতে পারে। আমার ভেতর এ ধরনের লোকদের প্রতি একটা সফট কর্ণার আছে। তবু ভিলেনতো ভিলেনই। এ লোক আমার জীবনের অন্যতম এক ভিলেন। একে কিছু দেখানোর জন্য বহু কষ্ট করেছি। কিছুটা দেখিয়েছি, কিছুটা পারিনি। যখন বুঝতে শিখলাম যে, পৃথিবীতে কোনো কিছুই অবিনশ্বর নয় তখন হাল ছেড়ে দিলাম। স্বপ্ন ছিলো লোকটাকে নি:স্ব করে দেবার। পারলাম না। তার আগেই সে নি:স্ব হয়ে গেছে। একে নি:স্ব করার মতো কোনো কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই। কিছুদিন আগে কিছু জমি দখলে নিয়েছি বটে কিন্তু সেটা তার কাছ থেকে নয়, ফুফুর কাছ থেকে। এতেও লোকটা কম ক্ষ্যাপেনি। আমার জন্মদাতাকে ফোনে কয়েক লাইন শুনিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আমিতো আমার জন্মদাতার মতো অতো সরল অংক নই। আমার বুদ্ধিজ্ঞান সুস্থির। যা করি ভেবেচিন্তে করি। ধীরে সুস্থ্যে ভাবি, ধীরে সুস্থ্যে করি। কোনো এক অদ্ভুত কারণে তারা আমাকে ফোন-টোন করেনা। সেটা নিয়ে আমি যে মাঝে মাঝে গবেষণা করিনা তাও না। আমার ঘৃনাটুকুর উত্তাপ তারা টের পায় বলেই আমাকে এড়িয়ে চলে, এ আমি ভালো জানি।

মানুষ বড় কালের স্মৃতিকে খুব একটা মনে রাখে না। মানুষের যতো ভাবনা চিন্তা তার শৈশোব কৈশোর নিয়েই। একটা শিশুকে কেউ চড় থাপ্পড় মারলে সে সেটা মনে রাখেনা। তার কাছে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু একটা শিশু যদি বুঝতে শেখে যে তার বাবা মা মানুষিকভাবে অত্যাচারিত; আত্মীয়রা তাদের নি:স্ব করার কুট চেষ্টা চালাচ্ছে, সে যখন বুঝতে পারে যে তার অগ্রজ নিজেকে উৎসর্গ করছে সংসার নামক ভাঙ্গা নৌকাকে টিকিয়ে রাখার জন্য তখন শতো চেষ্টা করেও তার মন থেকে চক্রান্তকারীদের প্রতি ঘৃনা মুছে ফেলতে পারেনা কেউ। আমি আজীবন ফুফু এবং বড় চাচাকে ঘৃনা করে এসেছি। ঘৃনা আমার বাপের পুরো গোষ্ঠির প্রতিই।

বড় চাচা'র সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ু কামনা করছি। হা হা হা হা হা, ইটস আ বিউটিফুল উইস। তিনি মরবেন, শিঘ্রির, ইহা চিরন্তন সত্য। তিনি মরলে আমার লাভ-ক্ষতিতে কোনো পরির্বতন ঘটবে না। তবু তিনি মরবেন ভেবে আমার আপসোস হচ্ছে। তার কারণ, এতে আমি আত্মতৃপ্তি খুঁজে পাচ্ছি না। তারা সবাই যদি একে একে লেজ তুলে পালাতে শুরু করে তো কাকে দেখাবো এতো জ্বালা? প্রতিপক্ষহীন দাবা খেলায় কোনো মজা নেই।

ও আবার আমার হাত ধরেছে। আমি কথা বলার ছলে হাতটা মুক্ত করলাম, আবার। সামনে ছোট এক তলা বাড়ি। বাড়ির চারপাশে বড়ই গাছ, লিচু, পেপেঁ থেকে শুরু করে কয়েক পদের গাছ। গাজিপুরে গাছপালা ভালোই। তারপরেও চাটগাঁয়ের মানুষ এরা। গাছের প্রতি এদের বাড়তি আকর্ষন থাকবেই। গেট খুলে দিলেন বড় চাচী। আমি তাকিয়ে আছি, উনিও। তারপর বললেন- বড় লোকের ছেলে আসলি তাহলে?
কটাক্ষ করলেন, কিন্তু কিছু বললাম না। মৃদু হেসে বললাম- আসলাম।

তিনি বড় চাচার কাছে নিয়ে গেলেন। রুমটা খুব ঠান্ডা হয়ে আছে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে অদ্ভুত এক গন্ধ। বিছানায় গরম চাদর দিয়ে ঢাকা একটা কঙ্কাল। চারদিকে চোখ বুলিয়ে কঙ্কালটার দিকে তাকালাম খুটিয়ে দেখবো বলে। আমি এর চোখে কিছু দেখতে চাই। বহু প্রত্যাশিত কিছু। দেখতে পেলাম না। তার বদলে মুখটায় বাসা বেধেছে অদ্ভুত এক শূণ্যতা। অদ্ভুত। কঙ্কালসার চোখে তার বোবা দৃষ্টি। কি ভাবছেন আমাকে দেখে, আমি রঙ্গ করতে এলাম নাকি প্রতিশোধ নিতে? কিছু টুকটাক খোঁজখবর যা না নিলেই নয়, নিলাম। দুই ছেলেই আলাদা থাকে। বড় ছেলে প্রবাসী। ছোট ছেলে দেখবাল করার প্রয়োজন অনুভব করেনা। মেয়েরাও দেখতে আসছেনা। এরা তাই প্রচন্ড একা। বুড়ো হলে সব মানুষ একা হয়না। একা হয় তারাই যারা মানুষকে একা করে। শুনলাম দিন ছয়েক আগে রাজ্যের আত্মীয়স্বজন এসে ভীড় করেছিলো। সে নাড়িতে টান পড়েছিলো বলে। মৃত্যুর সময় মৃত বাড়িতে থাকতে হয়। এটা এই সমাজের নিয়ম। মৃতের মৃত্যু নি:শ্বাসের পতনে এমন কি আছে যার জন্য পাবলিক উন্মুখ হয়ে থাকবে? ইশ্বর তা ভালো জানেন। কিছু কৌতুহল নিয়েও অনেকে আসে। অনেকে আসে অযথাই। অনেকে আসে লাভস্টোরীকে চমকপ্রদ করতে। এছাড়া কার কি ঠেলা পড়েছে এই স্বার্থপর কঙ্কালটাকে দেখার? এইযে এখন কাউকে দেখা যাচ্ছে না তারও কারণ আছে। সেটা হলো লোকটার মরার চান্স এখন কম। এই সমােজর মানুষরা ভাবে মৃত্যু কেবল আসে রাতেই। দিনের বেলায়ওযে মানুষের মৃত্যু হতে পারে এই চিন্তাটা এই সমাজের ৯০% মানুষ উপলব্ধি করেনা। তাদের মতে মৃ্ত্যু আসবে আধার রাতে। টুপ করে। সে মতে লোকটার মরার চান্স রাতে বেশি! 'রাতে বার বার নাকে আঙুল দিয়ে দেখি তিনি বেঁচে আছেন কিনা?' বড় চাচী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। তিনি যে খুব একটা স্বামী পূজারী তাও না। তিনি স্বামীর সেবা করছেন দায়ে পড়ে। এই কঙ্কালটা ব্যতিত তার যে আর কোনো অবলম্বন নাই! এই কঙ্গালটা আজ মরে গেলেই কাল সবাই এসে সংসারটাকে ভেঙ্গেচুড়ে তাকে নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলায় ব্যস্ত হবে, তা এই বুদ্ধিমান মেয়ে মানুষটা ভালোই জানে। আমি তার কথা শুনে চুপ মেরে যাই। সময় বয়ে চলে। এখন মরে যাওয়া রোদ্রুরের খেলা চলছে বাইরে, তুখোড় সুন্দর বিকেল। অথচ সম্ভাব্য এই মৃতের ঘরে ওসব অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে। লোকটা কি জানে সে বাঁচবে না?

অবশেষে লোকটা পরাজিত হলো। কেঁদে উঠলেন হঠাতই। বাঁধা দিলাম না। সান্তনাও না। শুধু তাকিয়ে থাকলাম। এ অশ্রু মিথ্যে নয়। এ আকুতি, চোখের ভাষা মিথ্যে নয়। কোথাও পরাজয়ের গ্লানি নেই। সেখানে স্নেহ আর অনুশোষনা টলটল করছে। আমার হাত ধরে তিনি উষ্ণতা খুঁজতে থাকেন। আমি খুঁজতে দিলাম। 'তুই দেখতে ঠিক তোর দাদীর মত। তোর দাদী খুব সুন্দর ছিলেন। মানুষকে বড় ভালোবাসতেন। যখন রাগতেন তখন কান্ডজ্ঞান তার ঠিক থাকতো না। আমার ছেলে মেয়েরা তার কিছুই পায়নি। না গায়ের রঙ, না তার স্বভাব।' বড় চাচী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আকাশ কি পেয়েছে? প্রশ্ন করে রুনু। সে বসেছে বিছানায়, গুটিশুটি মেয়ে হয়ে। তাকিয়ে আছে অদ্ভুত এক দৃষ্টি সাথে নিয়ে। বড় চাচী ফের দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন- সব। আমি মুচকি হাসি। এরা তাহলে আমাকে ভালোও বলে!

বেরিয়ে এলাম শেষ বিকেলে। রানা খুব বোরড হয়ে গেছে বুঝতে পারলাম। রুনু আমাদের এগিয়ে দিতে এলো ষ্ট্যান্ড পর্যন্ত। শরীরে আলস্য এনে রিক্সায় ওঠলাম। রানার সাথে কৌশল বিনিময় করে সে বিদায় দিলো। আমি শেষবারের মতো তাকালাম। হুমমম। সে কিছু বললোনা। কিছু তার বলারও নেই। আমারওনা। রিক্সা চলতে শুরু করেছে। সে হয়তো দাঁড়িয়ে আছে। হয়তোবা না। এটা নিয়ে ভাবার প্রয়োজনবোধ করছিনা। সে সুখে আছে, ঢেড় ভালো আছে। চিরকাল সুখে থাকুক সে কামনা করি। আমার প্রতিটি একাকিত্বের জ্বালা আমি নিজের জন্য রেখেছি। এর ছোঁয়া অন্য কাউকে স্পর্শ করুক সেটা চাইনা। এদের কেউ কেউ হয়তো নিরবে খুব দরদ দেখায়। সেটা আমি কেয়ার করিনা। মানুষের সব ফাঁকিবাজি নি:শ্বাসের সামনে এলে বুঝা যায়। অন্য কোনো ভাবে জানা সম্ভব নয়। তাই কোন মানুষ কেমন সেটা আমি ভালো বুঝি।



-- ৫ ডিসেম্বর, ২০০৭ইং।

Monday, December 3, 2007

এক আকাশ, স্বপ্ন

মিথুন রাশির জাতকেরা কেমন হয়? আকাশ অবশ্য কখনো রাশি-টাশি নিয়ে অতো গভিরভাবে নাড়াচাড়ি করেনি। তবে নিজেকে দিয়ে সে যা বুঝে তা হলো- মিথুন রাশির জাতকেরা হয়- প্রচন্ড ঘাড়ট্যারা, আত্মভোলা এবং চাপা রোমান্টিক। অন্যকিছুও হতে পারে। তবে ওর ব্যাপারটা আলাদা। সে প্রিয় মানুষকে যেমন ভালোবাসতে পারে, তেমন ঘৃনা করতে পারেনা। ভালোবাসা সম্পর্কে তার যে ধ্যনধারনা সেটাও কিন্তু কমজোরী নয়। তার মতে, হাসনাহেনার সুভাশ ফুলে নাক ডুবিয়ে পাওয়া সম্ভব নয়। এ থেকে যতদূরে তুমি ছুটবে তত তুমি এর সুভাশ পাবে। আকাশ দূর থেকে সুভাশ নিতে ভালোবাসে। এ বয়সে অনেকেই এক-আধটু ভুলভাল করে থাকে। তবু, কারো জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষায় থাকা, দিবানিশি পরস্পর বিরোধী দুটো স্বত্ত্বার সাথে যুদ্ধ করা, নিজের সমস্ত ধ্যনধারনার ঘষামাজা করা... ভুলভালের মধ্যে পরেনা। যদিও আকাশ অপেক্ষাকে মনে-প্রাণে ঘৃনা করে। তারপরও সে কারো কারো জন্য হঠাৎ হঠাৎ অকারণে অপেক্ষা করে। কেন করে সে তা জানেনা।

মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি হলো- যা সে পায়না তার জন্য সে ভিষন হায়-হুতাশ করে। যা সহজে পায় তা অবজ্ঞা ভরে দূরে সরিয়ে রাখে। আকাশ নিজেকে কম চেনেনা। তবু, মাঝে মাঝে তার নিজেরে নিদারুন করুন মনে হয়। প্রচন্ড অসহায় লাগে তখন। ভিষন একা আর ভিষন মুমূর্ষ মুহুর্ত্বে মানুষ প্রিয়জনের কাছে আশ্রয় চায়। সে চায়না। সে ভিষন মূর্খ পুজারী। সে ফুল দেখবে কিন্তু ছিঁড়বে না। সে ফুল নিজের করে চাইবে কিন্তু পাহারা দিবে না, গাছে পানি দেবে না।

মানুষই সম্ভবত একমাত্র জীব যে নিজেকে খুব দ্রুত বদলে ফেলতে পারে। আকাশ সেটা পারেনা। তার ধারনা মানুষ শুধুমাত্র তার বাইরের রূপটাই বদলাতে পারে, ভেতরটা নয়। কিন্তু মাঝে মাঝে তার বেশ ধান্দা লাগে। যা সে জানছে কিংবা যা সে ভাবছে তার পুরোটাই মিথ্যে নয়তো? মানুষতো প্রতিটি সেকেন্ড মরছে। প্রতিটি সেকেন্ড মানুষ এক একটা নতুন মানুষরূপে আবির্ভূত হচ্ছে। মানুষের ভেতরটাও বদলে যেতে পারে। মানুষের বাইরের পঁচন ভেতরে চলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। আজকাল ওর চিন্তা-ভাবনারা বড্ড বেশি ঠোঁটকাটা হয়েছে। তবু তারা মানুষকে ভালোবাসে। কারণ মানুষকে তাদের যান্ত্রিক আর কৃত্রিম বলে মনে হয়না। প্রতিটি মানুষই রহস্যঘেরা এক আঁধার। ওদের ভেতরটা শতোমুখী ইচ্ছে, স্বপ্ন, ঘৃনা, ভালোবাসায় ঠাসা। কিছু মানুষ আদতেই একটু অন্যরকম হয়। তারপরও অন্যসব মানুষের মতইতো তারা। তারা মরছে। প্রতিটি সেকেন্ড। প্রতিটি সেকেন্ড তারা নতুন করে কিছু ভাবছে। প্রতিটি মুহুর্তে তারা স্বপ্ন দেখছে নতুন কিছু নিয়ে। প্রতিটি সেকেন্ড তারা নতুন করে ভাবনার ঘুড়ি উড়োচ্ছে। মানুষ তাই সাংঘাতিক এক রাহস্যিক বিষয়। একজন মানুষের সাথে অন্য এক মানুষের কোনো মিল মহব্বত থাকার কথা নয়। তবু অনেক কিছু মিলে যায়। সেটাতো অন্য সব ক্ষেত্রেও মিলবে। শামুককে তার শক্ত খোলস দেখে যেভাবে সনাক্ত করা যায় তেমন মানুষকেও চেনা কঠিন কিছু নয়। শামুকের সহজাত প্রবৃত্তি হচ্ছে ধীরালয়ে হেঁটে চলা, কোনো বিপদ দেখলে খোলশের ভেতর নিজেকে গুটিয়ে ফেলা। তাই কোনো শামুক যদি মনে করে যে অমুক শামুকের সাথে তার বেশ মেলে সেটা কিন্তু যুক্তিহীন নয়। যুক্তিহীন হবে তখনই যখন কেউ বলবে- অমুক শামুককে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি, তখন। আকাশ অবশ্য এই ব্যাপারটা নিয়ে মনে মনে খুব হাসে। সে হয়তো কিছু মানুষকে হাড়ে হাড়েই চেনে। তার রহস্যঘেরা যন্ত্রণাময় জীবনে এ ব্যাপারটা একটা বিনোদন। পাখি যতই তুমি উড়ে বেড়াও, তোমায় আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। ইচ্ছে করলে তোমায় আমি উড়িয়ে দিতে পারি, ইচ্ছে করলে তোমায় খাঁচায় পুরতেও পারি... আকাশ মাঝে মাঝে খুব ভাবে উপেক্ষা সরিয়ে বুকে টেনে তাকে এসব শুনাতে। সে কয়েক সেকেন্ড। তারপর ভুলে যায়।

বর্ষা শেষ হয়েছে। বৃষ্টি নেই। বৃষ্টির টুপটাপটুপটাপ শব্দেরাও নেই। বেঁচে গেছি, আকাশ হাসে, একমনে। বৃষ্টির শব্দে তার বিয়ে করতে ইচ্ছে করে। এ ব্যাপারটা চিন্তা করলেই সে চুপসে যায়। তারপর নি:শব্দে হাঁটতে থাকে গন্তব্যহীন। বিয়ে করতে চাইলেতো আর করা যায়না। আকাশের নিজেরে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার ক্ষমতা নাই। তবু আকাশ বিয়ে করবে, বুড়ো বয়সে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটার সময়। তার একটা ইচ্ছে আছে বিয়ের পর বুড়িকে প্রতিদিন একটি করে চিঠি লিখবে! কি লিখবে তাতে? আকাশ যেমন মানুষ- লিখবে, আজকে আলু-ভর্তা সবচে' ফালতু হয়েছে। এমন কান্না-কাটি রান্না করলে দেশান্তরে যাবো। কিংবা। কিংবা। কিংবা? হা হা হা। এমনই। আকাশের ভালোবাসা এবং স্বপ্নো তীরহিত মেঘের মতো। ও ছোঁয়া যায়, একটু অন্যরকম করে। সুপ্ত ভালোবাসাটাও কেড়ে নেয়া যায়... বিমূর্ত ভালোবেসে।

Sunday, December 2, 2007

ভুল

নেট দুনিয়ায় আমার সবচেয়ে বড় দুটো ভুলের মধ্যে একটি হলো- রাজিবকে ফেসবুকে এ্যাড করা এবং একজনের সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দেয়া।

Saturday, December 1, 2007

উপেক্ষা

উপেক্ষা
--নির্মলেন্দু গুণ


বিরহ চাই,
ভালোবেসে কার্পণ্য শিখিনি৷
তোমার উপেক্ষা পেলে অনায়াসে ভুলে যেতে পারি
সমস্ত বোধের উত্স গ্রাস করা প্রেম; যদি চাও
ভুলে যাবো, তুমি শুধু কাছে এসে উপেক্ষা দেখাও৷


আমি কি ডরাই সখি,
ভালোবাসা ভিখারি বিরহে?