Monday, December 31, 2007

সৃষ্টি


প্রায় এক মাসের সফল কর্মসূচির পর বরগুনা থেকে যখন ঢাকায় ফিরলাম তখন শরীর/মনের অবস্থা যাচ্ছেতাই। মনে মনে ভাবছিলাম লম্বা এক ডুব দিবো। সবকিছু থেকে। খাবো, দাবো, ঘুমে ডোম হবো। তেমন কিছুই হতে দিলো না নিয়তি। জরুরী তলব, বাড়িতে কোরবানি করতে হবে। অবশেষে চাঁন রাতে শেষ টিকিট নিয়ে যখন সৌদিয়ার বাস সার্ভিসে চেপে বসলাম তখনই ফোন। জানানো হলো বড় চাচা মারা গেছেন। গাজীপুর, দেড় ঘন্টার পথ। আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হলো তড়িগড়ি। বাস ছেড়ে দিবে একটু পর। দশ-বিশ-ত্রিশ গুনতে হলোনা। কর্তব্য বলতে শুধু অ্যামেরিকায় এন্সারিং মেশিনে এক মিনিটের বক্তৃতা দিয়েই সিটে শরীর এলিয়ে গভির ঘুমে মগ্ন হলাম। লোকটার প্রতি আমার কোনো মায়া-মমতা ছিলোনা। এখনো নাই। আমার ভেতরে অনেক অনেক জ্বালা, কষ্ট, হতাশা জাগিয়ে লোকটা হুট করে চলে গেছে। এতে আমার হতাশা বেড়েছে বৈ কমেনি।

যাইহোক, নিজের গ্রামে কিছু একটা করার স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কিভাবে শুরু করবো। অবশেষে সেটা এবার দেখতে পেলাম। গ্রামের একটা অংশ বাকি অংশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিপার্শ্বিক সব দিক থেকে তারা পিছিয়ে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেলাম এখানে শিক্ষার হার অন্যান্য অংশের তুলনায় অনেক কম। বন্ধুরা বললো ল্যাদা-ফ্যাদাদের শিক্ষার দিকে নজর দিতে। তাহলেই উন্নয়ন সম্ভব। আমি সেদিকে হাঁটলাম না। মা'দের নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছে করলো। এখানে বয়স্ক/বিবাহিত মহিলাদের শিক্ষার হার অনেক কম। ভেবে দেখলাম যদি এদের কোনো ভাবে শিক্ষিত করতে পারি তাহলে বাজিমাত করা সম্ভব। একজন মা একটি পরিবারের মুল অভিভাবক। মা শিক্ষিত হলে ফ্যামিলি এমনিতেই ডেভেলপ করবে। একজন কর্মজীবি বাবা পরিবারে কতটুকু সময় দিতে পারে? মা পরিবারকে ২৪ ঘন্টা সময় দিয়ে থাকে। উপরোন্তু সন্তানরা বাবার চেয়ে মাকে খুব বেশি কাছে পায়। তারা মায়ের আদর, স্নেহ, ভালোবাসা পেয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। তাই একজন মা যা বলেন সন্তানরা তাই আগ্রহ ভরে করার চেষ্টা করে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সম্পর্কে মা'কে বুঝাতে পারলে পরিবেশের এমন ছ্যাঁড়াব্যাঁড়া অবস্থারও উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। তাই, মা'কে শিক্ষিত করতে পারলে সবকিছুকে শিক্ষিত করার একটা চান্স নেয়া যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো এই ঝানু মহিলাদের কিভাবে বোঝাবো। এর আগে এখানে সরকারীভাবে এমন উদ্যেগের কম চেষ্টা হয়নি। সবই শুরু হয়ে শেষ হয়ে গেছে। সুবিধে হলো এদের কাছে আমি মোটামুটি পরিচিত। আমার এই পরিচিত তাদের ভেতর বিপ্লব ঘটাতে পারে, তাই সুযোগটা কাজে লাগানোর জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলাম।

৫ সদস্যের একটা কমিটি করলাম। এরা ডোনেট করবে। মাসিক যা খরচ হবে তার পুরোটাই এরা বহন করবে। স্কুল ঘর ঠিক করার পর ঘরের মালিক জানালো তাকে ভাড়া দিতে হবে না। কমিটির সবাই এতে ভিষণ খুশি। 'সৃষ্টি' নিয়ে আজম আর মিলনের আগ্রহ দেখে ভালো লাগলো। আমার অবর্তমানে এরা এই কাজটাকে এগিয়ে নিতে পারবে মোটামুটি। অবশেষে চারজন শিক্ষিকার ব্যবস্থা করতে পারা গেল। এদের ৩ জন কোনো টাকা নিবে না। ১ জনকে মাসিক ১০০০ টাকা দিলেই চলবে! পূর্বে দেখতে পেয়েছি প্রায় প্রতিটি প্রোজেক্টের আগে একটা অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে হয়। যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক অনেক কম অর্থনৈতিক প্রেসার 'সৃষ্টিতে' পেলাম। পুরোপুরি গোছগাছ করে সবাইকে নিয়ে স্কুল ঘরে একটা মিটিং এর আয়োজন করা হলো। শুধুমাত্র ছাত্রীদের নিয়ে মিটিং। যারা আসবে তাদেরকে প্রাথমিকভাবে বিনামূল্যে বই, চক, ডাস্টার দেয়া হবে। আমার ধারনা ছিলো লজ্জা-শরম দূরে হটিয়ে ৭/৮জন মতো হয়তো আসবে। সেই অনুযায়ী ১২ জনের জন্য জিনিসপত্র কিনে আনা হয়েছিল। বিপত্তি ঘটলো মিটিংয়ে মহিলাদের উপস্থিতির পর। ৩০/৩৫ জন ছাত্রী দেখে আমার মতই সবাই তাজ্জব! যাই-হোক, ২০ মিনিট টানা ব্রিফ দিলাম। সুবিধে হলো এদের চোখে সহজেই জল এনে ফেলা যায়। এদের একটু ভালোবাসা দেখাতে পারলে এরা মানুষের জন্য কি না করতে পারে? তাদেরকে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হলে :

১। ছাত্রীদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পাঠ্যেদান করা হবে।
২। সপ্তায় ৬ দিন ক্লাশ হবে। ক্লাশ শুরু হবে বিকেল ৩টায়।
৩। ১ জন শিক্ষক সপ্তায় ২টি করে ক্লাশ নিবেন।
৪। সপ্তাহের প্রতি বৃহ:স্পতিবার একটি করে মিটিং হবে। এখানে ছাত্রীদের প্রোগ্রেস, তাদের সমস্যা, অভিযোগ, পারিপার্শ্বিক বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা হবে। অভিযোগ, সমস্যাগুলো আজম লিপিবদ্ধ করে রাখবে। পরের ক্লাশ থেকে তা সংশোধনের চেষ্টা করা হবে।
৫। প্রত্যেক মাসে একটি করে বড় মিটিং হবে। সেখানে কমিটির সবাই উপস্থিত থাকবো। যাবতীয় সমস্যা সমাধান দেয়ার চেষ্টা করা হবে তখন। মজার মজার সব ইভেন্টের মাধ্যমে ছাত্রীদের শিক্ষার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হবে।
৬। কোনো কারণ ছাড়াই কেউ তিন দিন ক্লাশে অনুপস্থিত থাকলে পরবর্তী অনুপস্থিত ক্লাশের জন্য ২ টাকা হারে জরিমানা করা হবে।
৭। আরো কিছু...।

এর মানে হলো আমাকে প্রতি মাসে গ্রামে যেতে হবেই! আমি ত্যাক্ত বিরক্ত হবো না। বরং প্রোজেক্টটা দাঁড়িয়ে গেলে আমার চেয়ে সুখি মানুষ পৃথিবীতে পাওয়া ভার হবে। 'সৃষ্টি' নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। সমস্যা হলো তেমন অরগানাইজ জনোবল নাই। যে চারজন কমিটিতে আছে তারা হাঁ হয়ে আমার সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করে। আমার চাই অরগানাইজ জনোবল আর পাশে দাঁড়িয়ে আশ্বাস দেবার মতো প্রিয়জন। তেমন পাওয়া ভার। দাঁড়িয়াল ঠাকুরের কবিতাই এখন শেষ সম্বল, "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলোরে..."

1 comment:

Anika said...

vai... ami srishti niye ro ektu jante chai.... ki koro ashole?