Friday, December 7, 2007

প্রতিপক্ষহীন এই জীবন

তার এই অযাচিত উদ্ব্যেগটা আমার যে ভালো লাগছিলো না তা নয়। ভালো লাগছিলো, একই সাথে একটা ক্ষীন দু:খবোধ। এটা হবার কথা নয়। সময়ের প্যাঁচে মানুষ হারায়ে যায়... এটা ধ্রুব সত্য। একে নিয়ে দু:খবোধ করাটা ঠিক না। রিক্সায় বসেই ওকে দেখতে পেলাম। চোখে মুখে উদ্বেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কতদিন পর গাজিপুর এলাম? সঠিক জানা নেই। তবে অনেক অনেক দিন পর এলাম। পথ ঘাটের কিছুই তেমন চিনি না। বিবর্ণ সবকিছু। মানুষগুলো কেমন তা ঈশ্বর ভালো জানেন। ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম হয়তো সাজবে। সাজেনি। এ মেয়ে কখনোই অতিরিক্ত প্রসাধন ব্যবহার করেনা। সাধারণ সালোয়ার কামিজ পরনে। গায়ে আকাশ রঙের ওরণা। অস্থির আর উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। আমি তার চোখে কৈশোরকে জ্বলতে দেখলাম। হেসে বললো --এতো দেরী লাগে?
-- পথ ঘাটতো চিনি না। পরিচয় হও, আমার বন্ধু রানা।
শেষবার মাস চারেক আগে দেখা হয়েছিলো। তখন এরকম সুস্থির ভাব ছিলো না। সুখে আছে? দু:খবোধটা আরো শক্তপোক্ত অবস্থানে মোড় নেয়। অথচ দু:খবোধ করার কোনো মানে নেই। মানুষ সুখে থাকবেই। কথার ফাঁকে ফাঁকে ও মৃদু শব্দে হাসছিলো। অচেনা এই হাসিটা সম্পূর্ণ আনকোরা। আগে কখনো দেখিনি। মেয়েদের হাসিও তাহলে সময়ের সাথে পাল্টায়! হাঁটছি এলেবেলে কথাবার্তা বলতে বলতে। হঠাৎই, সেই আগের মতো করে আমার এক হাতে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে শুরু করেছে। মনে মনে ভিষন চমকে গেলেও কিছু বললাম না। হাত ছাড়িয়ে নিলাম কথার বাঁকে। যা চুকেবুকে গেছে তাকে জোর করে দৃশ্যপটে হাজির করাটা বোকামী। এ আমি জানি। এমনিতে অভিমান টবিমানের মতো লাল্লু মার্কা অনুভূতিজ্ঞান আমার ভোঁতা। তারপরেও কিছু ব্যাপার থেকে যায়। সেসব থেকে নিজেকে মুক্ত করা কঠিন। ঢাকায় এতোবার দেখা হয়েছে এমন কখনোই হয়নি। রানা পেছনে সরে যায়। গাছের পাতা নড়েছে। কোনো একটা কারণ অবশ্যই আছে। ধক করে ভ্রুটা কুঁচকে যায়। রানা হচ্ছে জীবন্ত বি.বি.সি। বন্ধু সার্কেলের কারো কিছু রানার জ্ঞাত হওয়া মানে সবার জ্ঞাত হওয়া। ঈশ্বর জানেন আমাকে নিয়ে ভবিষ্যতে কি ঘটাবে সে।

বড় চাচা'র বাড়ি যাচ্ছি ১২ থেকে ১৫ বছর বছর পর। এই একটা লোককে আমি চরম ঘৃনা করি। এক সময় দারুন প্রতাপ ছিলো। এখন তার কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই। মি. প্রতাপ মৃত্যুর প্রহর গুনছে আজ। তবু তার একটা বিষয় আমার ভালো লাগে, সেটা হলো লোকটা দারুন ঠোঁটকাটা। মুখের উপর শাট শাট কথা বলতে পারে। আমার ভেতর এ ধরনের লোকদের প্রতি একটা সফট কর্ণার আছে। তবু ভিলেনতো ভিলেনই। এ লোক আমার জীবনের অন্যতম এক ভিলেন। একে কিছু দেখানোর জন্য বহু কষ্ট করেছি। কিছুটা দেখিয়েছি, কিছুটা পারিনি। যখন বুঝতে শিখলাম যে, পৃথিবীতে কোনো কিছুই অবিনশ্বর নয় তখন হাল ছেড়ে দিলাম। স্বপ্ন ছিলো লোকটাকে নি:স্ব করে দেবার। পারলাম না। তার আগেই সে নি:স্ব হয়ে গেছে। একে নি:স্ব করার মতো কোনো কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই। কিছুদিন আগে কিছু জমি দখলে নিয়েছি বটে কিন্তু সেটা তার কাছ থেকে নয়, ফুফুর কাছ থেকে। এতেও লোকটা কম ক্ষ্যাপেনি। আমার জন্মদাতাকে ফোনে কয়েক লাইন শুনিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আমিতো আমার জন্মদাতার মতো অতো সরল অংক নই। আমার বুদ্ধিজ্ঞান সুস্থির। যা করি ভেবেচিন্তে করি। ধীরে সুস্থ্যে ভাবি, ধীরে সুস্থ্যে করি। কোনো এক অদ্ভুত কারণে তারা আমাকে ফোন-টোন করেনা। সেটা নিয়ে আমি যে মাঝে মাঝে গবেষণা করিনা তাও না। আমার ঘৃনাটুকুর উত্তাপ তারা টের পায় বলেই আমাকে এড়িয়ে চলে, এ আমি ভালো জানি।

মানুষ বড় কালের স্মৃতিকে খুব একটা মনে রাখে না। মানুষের যতো ভাবনা চিন্তা তার শৈশোব কৈশোর নিয়েই। একটা শিশুকে কেউ চড় থাপ্পড় মারলে সে সেটা মনে রাখেনা। তার কাছে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু একটা শিশু যদি বুঝতে শেখে যে তার বাবা মা মানুষিকভাবে অত্যাচারিত; আত্মীয়রা তাদের নি:স্ব করার কুট চেষ্টা চালাচ্ছে, সে যখন বুঝতে পারে যে তার অগ্রজ নিজেকে উৎসর্গ করছে সংসার নামক ভাঙ্গা নৌকাকে টিকিয়ে রাখার জন্য তখন শতো চেষ্টা করেও তার মন থেকে চক্রান্তকারীদের প্রতি ঘৃনা মুছে ফেলতে পারেনা কেউ। আমি আজীবন ফুফু এবং বড় চাচাকে ঘৃনা করে এসেছি। ঘৃনা আমার বাপের পুরো গোষ্ঠির প্রতিই।

বড় চাচা'র সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ু কামনা করছি। হা হা হা হা হা, ইটস আ বিউটিফুল উইস। তিনি মরবেন, শিঘ্রির, ইহা চিরন্তন সত্য। তিনি মরলে আমার লাভ-ক্ষতিতে কোনো পরির্বতন ঘটবে না। তবু তিনি মরবেন ভেবে আমার আপসোস হচ্ছে। তার কারণ, এতে আমি আত্মতৃপ্তি খুঁজে পাচ্ছি না। তারা সবাই যদি একে একে লেজ তুলে পালাতে শুরু করে তো কাকে দেখাবো এতো জ্বালা? প্রতিপক্ষহীন দাবা খেলায় কোনো মজা নেই।

ও আবার আমার হাত ধরেছে। আমি কথা বলার ছলে হাতটা মুক্ত করলাম, আবার। সামনে ছোট এক তলা বাড়ি। বাড়ির চারপাশে বড়ই গাছ, লিচু, পেপেঁ থেকে শুরু করে কয়েক পদের গাছ। গাজিপুরে গাছপালা ভালোই। তারপরেও চাটগাঁয়ের মানুষ এরা। গাছের প্রতি এদের বাড়তি আকর্ষন থাকবেই। গেট খুলে দিলেন বড় চাচী। আমি তাকিয়ে আছি, উনিও। তারপর বললেন- বড় লোকের ছেলে আসলি তাহলে?
কটাক্ষ করলেন, কিন্তু কিছু বললাম না। মৃদু হেসে বললাম- আসলাম।

তিনি বড় চাচার কাছে নিয়ে গেলেন। রুমটা খুব ঠান্ডা হয়ে আছে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে অদ্ভুত এক গন্ধ। বিছানায় গরম চাদর দিয়ে ঢাকা একটা কঙ্কাল। চারদিকে চোখ বুলিয়ে কঙ্কালটার দিকে তাকালাম খুটিয়ে দেখবো বলে। আমি এর চোখে কিছু দেখতে চাই। বহু প্রত্যাশিত কিছু। দেখতে পেলাম না। তার বদলে মুখটায় বাসা বেধেছে অদ্ভুত এক শূণ্যতা। অদ্ভুত। কঙ্কালসার চোখে তার বোবা দৃষ্টি। কি ভাবছেন আমাকে দেখে, আমি রঙ্গ করতে এলাম নাকি প্রতিশোধ নিতে? কিছু টুকটাক খোঁজখবর যা না নিলেই নয়, নিলাম। দুই ছেলেই আলাদা থাকে। বড় ছেলে প্রবাসী। ছোট ছেলে দেখবাল করার প্রয়োজন অনুভব করেনা। মেয়েরাও দেখতে আসছেনা। এরা তাই প্রচন্ড একা। বুড়ো হলে সব মানুষ একা হয়না। একা হয় তারাই যারা মানুষকে একা করে। শুনলাম দিন ছয়েক আগে রাজ্যের আত্মীয়স্বজন এসে ভীড় করেছিলো। সে নাড়িতে টান পড়েছিলো বলে। মৃত্যুর সময় মৃত বাড়িতে থাকতে হয়। এটা এই সমাজের নিয়ম। মৃতের মৃত্যু নি:শ্বাসের পতনে এমন কি আছে যার জন্য পাবলিক উন্মুখ হয়ে থাকবে? ইশ্বর তা ভালো জানেন। কিছু কৌতুহল নিয়েও অনেকে আসে। অনেকে আসে অযথাই। অনেকে আসে লাভস্টোরীকে চমকপ্রদ করতে। এছাড়া কার কি ঠেলা পড়েছে এই স্বার্থপর কঙ্কালটাকে দেখার? এইযে এখন কাউকে দেখা যাচ্ছে না তারও কারণ আছে। সেটা হলো লোকটার মরার চান্স এখন কম। এই সমােজর মানুষরা ভাবে মৃত্যু কেবল আসে রাতেই। দিনের বেলায়ওযে মানুষের মৃত্যু হতে পারে এই চিন্তাটা এই সমাজের ৯০% মানুষ উপলব্ধি করেনা। তাদের মতে মৃ্ত্যু আসবে আধার রাতে। টুপ করে। সে মতে লোকটার মরার চান্স রাতে বেশি! 'রাতে বার বার নাকে আঙুল দিয়ে দেখি তিনি বেঁচে আছেন কিনা?' বড় চাচী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। তিনি যে খুব একটা স্বামী পূজারী তাও না। তিনি স্বামীর সেবা করছেন দায়ে পড়ে। এই কঙ্কালটা ব্যতিত তার যে আর কোনো অবলম্বন নাই! এই কঙ্গালটা আজ মরে গেলেই কাল সবাই এসে সংসারটাকে ভেঙ্গেচুড়ে তাকে নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলায় ব্যস্ত হবে, তা এই বুদ্ধিমান মেয়ে মানুষটা ভালোই জানে। আমি তার কথা শুনে চুপ মেরে যাই। সময় বয়ে চলে। এখন মরে যাওয়া রোদ্রুরের খেলা চলছে বাইরে, তুখোড় সুন্দর বিকেল। অথচ সম্ভাব্য এই মৃতের ঘরে ওসব অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে। লোকটা কি জানে সে বাঁচবে না?

অবশেষে লোকটা পরাজিত হলো। কেঁদে উঠলেন হঠাতই। বাঁধা দিলাম না। সান্তনাও না। শুধু তাকিয়ে থাকলাম। এ অশ্রু মিথ্যে নয়। এ আকুতি, চোখের ভাষা মিথ্যে নয়। কোথাও পরাজয়ের গ্লানি নেই। সেখানে স্নেহ আর অনুশোষনা টলটল করছে। আমার হাত ধরে তিনি উষ্ণতা খুঁজতে থাকেন। আমি খুঁজতে দিলাম। 'তুই দেখতে ঠিক তোর দাদীর মত। তোর দাদী খুব সুন্দর ছিলেন। মানুষকে বড় ভালোবাসতেন। যখন রাগতেন তখন কান্ডজ্ঞান তার ঠিক থাকতো না। আমার ছেলে মেয়েরা তার কিছুই পায়নি। না গায়ের রঙ, না তার স্বভাব।' বড় চাচী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আকাশ কি পেয়েছে? প্রশ্ন করে রুনু। সে বসেছে বিছানায়, গুটিশুটি মেয়ে হয়ে। তাকিয়ে আছে অদ্ভুত এক দৃষ্টি সাথে নিয়ে। বড় চাচী ফের দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন- সব। আমি মুচকি হাসি। এরা তাহলে আমাকে ভালোও বলে!

বেরিয়ে এলাম শেষ বিকেলে। রানা খুব বোরড হয়ে গেছে বুঝতে পারলাম। রুনু আমাদের এগিয়ে দিতে এলো ষ্ট্যান্ড পর্যন্ত। শরীরে আলস্য এনে রিক্সায় ওঠলাম। রানার সাথে কৌশল বিনিময় করে সে বিদায় দিলো। আমি শেষবারের মতো তাকালাম। হুমমম। সে কিছু বললোনা। কিছু তার বলারও নেই। আমারওনা। রিক্সা চলতে শুরু করেছে। সে হয়তো দাঁড়িয়ে আছে। হয়তোবা না। এটা নিয়ে ভাবার প্রয়োজনবোধ করছিনা। সে সুখে আছে, ঢেড় ভালো আছে। চিরকাল সুখে থাকুক সে কামনা করি। আমার প্রতিটি একাকিত্বের জ্বালা আমি নিজের জন্য রেখেছি। এর ছোঁয়া অন্য কাউকে স্পর্শ করুক সেটা চাইনা। এদের কেউ কেউ হয়তো নিরবে খুব দরদ দেখায়। সেটা আমি কেয়ার করিনা। মানুষের সব ফাঁকিবাজি নি:শ্বাসের সামনে এলে বুঝা যায়। অন্য কোনো ভাবে জানা সম্ভব নয়। তাই কোন মানুষ কেমন সেটা আমি ভালো বুঝি।



-- ৫ ডিসেম্বর, ২০০৭ইং।

2 comments:

শাওন said...

lekhar shomporke amar kichui bolar nei . zemon hoy temon i hoeche .
boro chachar kotakhota chokhe legeche .

ami kaoke emon korte parina . ze amar shorbo nisho kore dieche takeo konodin bolte parbona .

meyeta tar mane boro chachar meye naki onno keo . clear bujhlam na .

ছেঁড়া মানুষের গল্প said...

meyeta k tor bujhar dorkar nai. chilo keo, kono ek somoy. lekhata likhechilam 5 tarikher rate. porer din post korechi and arekbar reading porei post korechi. ja likhechi ta amar kache right mone hoyeche. jake ghrina korechi ta janate amar badhbe keno? tobe shotti bolte ki, ekhon r take ghrina kori na may be :| keno kori na sheta thik bujhano jabe na.

valo thakish.